Tuesday 16 August 2022

মাস্টার াানোয়ার হোসেন এর ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আনোয়ার ট্রাস্ট চেয়ারম্যান আনোয়ার আশরাফ এর স্মৃতিচারণ।

 সেদিন ছিলো ১৫ আগস্ট ভোর রাত ৪.০০ টা ১৯৮৯ সাল। রাত প্রায় ৩.০০ টার সময় নুরছাফা কাকা (আমার ভাতিজা এবং রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গুরু) বাবার কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে বাড়ী ফেরার সময় আমাকে বললেন সতর্ক ও শক্ত হও সবকিছু তোমাকেই মেনে নিয়ে সামলাতে হবে। তখনও গুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে মাত্র ১ ঘন্টার মাথায় আমি এতিম বনে যাবো।

নুরছাফা

কাকা বিদায় নেবার পর আমি বাবার কাছে গেলাম। আমার মেঝো দুলাভাই এবং আম্মা সেখানে বরাবরের মত সেবা যত্নের দায়িত্বে আছেন। এক পর্যায়ে বাবার জন্য পানি গরম করতে আম্মা রান্নাঘরে গেলে আমি বাবার পাশে গিয়ে বসি। বাবা দক্ষিন বারান্দায় ছিলেন, কেমন যেন মনে হলো বাবার পায়ের কাছে পিপড়া জাতীয় কিছু একটা হাটছে, আমি পায়ের কাছে গেলাম হারিকেন এর সাহায্যে পিপড়া খোঁজাখুজি করে কিছুই পেলাম না। সে সময় হঠাৎ বাবা চোখ মেলেন। মেঝো দুলাভাই জিজ্ঞেস করলেন আব্বা কিছু বলবেন? বাবা কিছু না বলে আমার দিকে তাকালেন আমি উঠে দাঁড়ালাম নিমিষেই বাবা ডান হাত উপরে তুলে কলেমা পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে আল্লাহ শব্দটি উচ্চারণ করলেন। মনে হলো আরো কিছু বলবেন কিন্তু মেঝো দুলাভাই বলে উঠলেন আব্বা আর নেই, উনি সেরে গেছেন........
মানুষের মৃত্যু এত সহজ স্বাভাবিক হতে পারে প্রথম চোখের সামনে দেখলাম। নিমিষেই বাবা না ফেরার দেশে চলে গেলেন... সে থেকে আমি পিতৃহারা। আমি এতিম। আমি নিঃস্ব।
আমার শিশু কাল থেকে কখনো বাবাকে অসুস্থ হতে দেখিনি। আমার উচ্চ মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষার কয়েকদিন পরে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। চট্টগ্রাম শহরে চিকিৎসার জন্য নুরছাফা কাকা ও মেঝো দুলাভাই কে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি সাথে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, কান্নাকাটিও করলাম, সেদিন আমাকে শান্তনা দিয়ে বাবা যে কয়টি কথা বললেন তাহা আজীবন আমার পাথেয় হয়ে থাকুক।
বাবা বলেছিলেন তুমি আমার বড় ছেলে তুমি যদি কান্নাকাটি কর ছোটরা কি করবে, তোমার বোন তারা, ছোটভাই আবসার ওরা কি করবে।ওদের কথা মনে রেখে হলেও কান্না থামাও। আরিফ তো এখনো শিশু, সে আজো ভালোভাবে জানেনা বাবা কাকে বলে। তুমিতো আমার অনেক সান্নিধ্য পেয়েছো, আমরা একসাথে খেয়েছি, টুকিটাকি কাজ করেছি, বাজার করেছি, নোয়াখালী কোম্পানি গঞ্জ (বালুরচর), চট্টগ্রাম শহর, সুফি শাহ্ হুজুরের দরগাহে গিয়েছি, খেলাধুলা নাটক এমনকি হলে গিয়ে সিনেমা পর্যন্ত একসাথে দেখেছি। বাকিরা তো কোন কিছুর সুযোগও পেলো না। এখন তুমি ভালোভাবে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলেই বাবা সুস্থ হয়ে যাবো, তোমার লেখাপড়াই আমার সুচিকিৎসা।
রিক্সায় উঠে গেলেন বাবা, আমরা পিছনে হাটছিলাম। নোয়াবাড়ীর (টিপু সুলতানের বাড়ী) সামনে দিয়ে যেতেই হঠাত রিক্সা থামালেন, ইশারায় কাছে ডাকলেন আমাকে। জীবনে প্রথমবারের মত দেখলাম বাবার চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরছে। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন তোমার বড় একটি বোন পঙ্গু, বাবা হয়ে তাকে সুস্থ দেখে যেতে পারলাম না, আর তোমার বুবুজান-দিদি, তাদের নিজের মায়ের পেটের একটা ভাই ও নাই। আমার বিশ্বাস তুমি তাদের সে দুঃখ মুছে দিবে। এই বলে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বাবা বাড়ি ফিরতে বললেন।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতাল, চন্দ্রঘোনা মিশনারী হাসপাতালেও বাবার চিকিৎসা হলো। অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হলো না। আসলে মরন ব্যাধি পেয়ে বসেছিলো বাবাকে।
আমি ফাইনাল পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরলে বাবা জিজ্ঞেস করলেন "বাবাজান তোমার পরীক্ষা কেমন হলো" আমি বললাম ভালো হয়েছে আব্বা। জিজ্ঞেস করলেন তোমার ক্লাসমেটদের বাবারা পরীক্ষার সময় দেখাশোনা করতে গিয়েছিলো, না?
আমি বললাম হ্যাঁ। অনেকের বাবা, গার্ডিয়ানরা গিয়েছিল। বাবা দুঃখ করে বললেন আমি এমন এক হতভাগ্য পিতা একবারের জন্য ও তোমাকে দেখতে যেতে পারলাম না।
তবে বিশ্বাস আছে আমার ছেলের পরীক্ষা অন্তত খারাপ হতে পারে না।
পরীক্ষার ফলাফল ঘোষনার কিছুদিন আগেই বাবাকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম, আমি ভালো রেজাল্ট করলাম কিন্তু আফসোস বাবা আমার পাশের খবরটা পর্যন্ত জেনে যেতে পারলেন না।