Sunday 20 November 2016

হাসান আজিজুল হক বললেন 'রাজনীতি ছাড়া কোনো মানুষ হয় না'- AnwarTrust

হাসান আজিজুল হক বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান লেখক, বাঙালি জীবন ও সমাজের সার্থক রূপকার। ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবাংলার বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিবিষ্ট কথাসাহিত্য চর্চায়। লেখার মধ্য দিয়ে সমাজ বাস্তবতার চিত্র ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি, মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি চেয়েছেন এবং ব্যক্তি মানুষকে স্বাধীন হিসেবে দেখতে চেয়েছেন সারাজীবন। কথাশিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বকৃত নোমান স্বকৃত নোমান :জীবনের প্রায় পুরোটা সময় আপনি কেন্দ্র থেকে দূরে থাকলেন। এই দূরে থাকাটা আপনার ভেতরে কোনো অভাববোধ বা শূন্যতা কাজ করেছে কি-না? আপনি কি মনে করেন, কেন্দ্রে থাকলে আরও ভালো করতেন? হাসান আজিজুল হক :এক কথায়, এক শব্দে জবাব দিই_ না। ষআমাদের শিল্প-সাহিত্য এখন অনেকটা ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। যারা প্রান্তে থেকে শিল্প-সাহিত্য চর্চা করছেন তারা এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন_ প্রান্তে থেকে বুঝি কিছুই হয় না; কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব হয় না। তাই সবাই কেন্দ্রের দিকে ছোটে। আবার কেন্দ্রে যারা আছেন তারাও ভাবেন, প্রান্তে যারা আছেন তাদের বুঝি কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা তো ব্যতিক্রম। আমরা অনেককেই দেখি, যারা প্রান্তে থেকেও কেন্দ্রের চাইতে অনেক ভালো করেছেন। সামগ্রিক ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার কী মতামত? ষষএই মনোভাব আসলে এক ধরনের গ্রাম্যতা। মফস্বলে যারা আছে তারা মফস্বলে আছে বলেই তাদের কোনো রকম এক্সপোজার নেই; আর রাজধানীতে আছে বলে এদের এক্সপোজার আছে_ মূল ব্যাপারটাই গ্রাম্যতা। গোটা দেশের লোকের মনের মধ্যে এ ধরনের একটা ব্যাপার আছে যে, যা কিছু করতে হবে সব ঢাকাতেই করতে হবে। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব রয়েছেন, যারা বলেন, জীবনের সবকিছু ছেড়ে দেব, কিন্তু ঢাকা কোনোদিন ছাড়ব না। আমার কাছে মূলত মনে হয়, এই মনোভাবটাই হচ্ছে গ্রাম্যতা। কোনো উন্নত জায়গা তথা উন্নত দেশে এই মফস্বল ও রাজধানীর পার্থক্য হয় না। হয় না এই জন্য, ওখানে যে সংস্কৃতি, যে সাহিত্য বা শিল্পটা তৈরি হয়_ নানা স্তরে তার মালিকানা ভাগ হয়ে গেছে। আমাদের এখানে তাই চলছে। আমাদের এখানে নানা সিঁড়ি আছে। একেক সিঁড়িতে একেকজনের অবস্থান। আমাদের এখানে বড়লোকদের কোনো সিঁড়ি নেই। অর্থাৎ তাদের কোনো সংস্কৃতিও নেই; দরকারও হয় না, ধারও ধারে না তারা। বিশেষ করে একালে যারা খুব বড়লোক হয়েছে তাদের বড়লোক হওয়ার পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আমি মন্তব্য করার কোনো প্রয়োজন মনে করি না। কারণ, এটা বাংলাদেশের সবার সামনে দিবালোকে ডাকাতির মতোই পরিষ্কার। তাই এটা নিয়ে কিছু বলার নেই। তাহলে আমাদের বাকি যে সংস্কৃতিটা, যাকে মূলত একটু উচ্চবিত্ত শ্রেণী বলা যায়, সচ্ছল মধ্যবিত্ত বলা যায় এবং টেনেটুনে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত বলা যায়। এটা হচ্ছে খাঁটি, নির্মম, বাস্তব সত্য কথা। আমরা যারা কাজ করছি, এই সীমাবদ্ধতা বুঝে চলি। আমরা যখন গ্রামীণ সংস্কৃতির জন্য আফসোস করি, আক্ষেপ করি, ফিরিয়ে আনতে চাই_ সেটাও কিন্তু মূলত একটা রোমান্টিক জায়গা থেকেই চাই। সেটা বিমূর্ত একটা জায়গা থেকে তা আমরা করি। যেটা বাস্তবে কখনোই অনুভব করি না। তারপর যেটুকু চর্চা গ্রামীণ সংস্কৃতির জন্য কিংবা আমাদের চিরকালীন ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত-নাটক ইত্যাদি যেটুকু আমরা প্রকাশ করি, এটা কিন্তু বাস্তব মধ্যবিত্তের জায়গা থেকেই করি। মধ্যবিত্তেরই আফসোস এটা। এবং মধ্যবিত্তই এটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে; যে জিনিসটা কখনোই কার্যকর হবে না। এ সমস্ত দোষ আমাদের সমাজে শেষ নেই। আমরা যা কিছু করি তা সবার নয়। হাসান আজিজুল হক যতই জনগণের জন্য লিখে থাকুন না কেন, জনগণ তার পাঠক নয়। আমার সমস্ত সম্বোধন শেষ পর্যন্ত গিয়ে আমার শ্রেণীর লোকের কাছেই আসে। এই নির্মম সত্যটা মেনে নিয়ে, এর সীমাবদ্ধতাটা স্বীকার করে নিয়ে আমি লেখক হয়েছি। আমি তবু মনে করি, এটা একেবারেই বৃথা যাবে না। নিশ্চয়ই যাবে না। কেননা, সমাজ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকছে না। বিত্ত বাড়ছে আর বহু লোক নিজেদের শ্রেণীকে পরিত্যাগ করে আসছে এবং যাবে। যেটাকে বলে, বালির মধ্যে যদি পানি ঢালো, তবে পানিটা পরিশ্রুত হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় নিচে যায়। এ রকম কোনো একটা পদ্ধতিতে জনগণের কাছ পর্যন্ত একটা জিনিস পেঁৗছুবে_ এই আশা যদি না করতাম, তাহলে হয়তো লেখক হতে পারতাম না। কাজেই তুমি ঢাকাকেন্দ্রিকতার প্রথম যে প্রশ্ন করলে, যে প্রশ্নের জবাব এক কথায় দিয়েছিলাম_ না। তার কারণ, পুরো অবস্থাটাকে আমি পরিত্যাগ করি। আমরা যখন সহানুভূতির মন দিয়ে ওই গ্রামের মানুষদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য গ্রামে যাই, বক্তৃতা করি, তখন আসলে অহংবোধ কাজ করে। আমি যখন বলি, আমার গ্রামীণ সংস্কৃতি বা আমার বাংলা গানের কী বৈভব ছিল! তাই জারিগানের দলটাকে বরিশাল থেকে শহরে নিয়ে এসেছি, বা আমাদের সাঁওতালদের নাচটা কেমন ছিল তা দেখার জন্য নিয়ে এসেছি শহরে। এটা কিন্তু আসলে এক ধরনের প্রদর্শন। এটা কিন্তু তাদের জীবনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত নয়। গ্রামগুলো কিন্তু মরে গেছে। সাঁওতাল গ্রামগুলো তো মৃত গ্রাম। আমি এক জায়গায় বলেছি, সেখানে শুয়োরেরও স্বাস্থ্য খারাপ! সেখানকার হাঁসের স্বাস্থ্য খারাপ, ছাগল এবং গরুগুলোও শীর্ণ। দারিদ্র্য তাদের বহু দূরে নিয়ে গেছে। সেখানে বিশ্বব্যাংকের হিসাব, সরকারের হিসাব, বুদ্ধিজীবীদের হিসাব কিছুই যে মেলে না_ এ কথাগুলো কে বোঝাবে! ড. মুহাম্মদ ইউনূস যতই করুন না কেন, কিছুই হচ্ছে না। মাংস ওভাবে লাগে না। গায়ে মাংস লাগাতে গেলে পুষ্টিটা সমস্ত শরীরে যেতে হবে। নিজের সম্বন্ধে এ কথাটা বলা যায়। যদিও সেসব সমাজে এক ধরনের শোষণের রূপ আছে, শ্রেণী বিভাগ আছে। তুমি বলতে পার আমেরিকা বা রাশিয়ার মতো দেশেও আছে। কিন্তু সেখানে যেটা বলেছিলাম_ এক ধরনের পরিশ্রুত হয়ে তলা পর্যন্ত পেঁৗছেছে। সম্প্র্রতি রাশিয়ান এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। বললাম, তোমরা এত করতে পার, তোমাদের প্রকাশনা থেকে বাংলায় কত রাশান গ্রন্থের অনুবাদ করছ। কিন্তু টলস্টয়ের অনুবাদ করাও না কেন? 'ওয়ার অ্যান্ড পিস'-এর অনুবাদ হয় না কেন? করলে তো আমরা পড়তে পারতাম। আমরা তো সঠিক অনুবাদ করতেও পারি না। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য যে টলস্টয়ের অনুবাদ করেছিলেন, সেটা প্রকৃত অনুবাদ নয়। তোমরা কেন কর না? উত্তরে সে বলল, বাংলা ভাষায় বের করা তো দূরের কথা, আমরা রাশানও করি না। তার কারণ, আমাদের দেশের লোক সেন্ট পার্সেন্ট শিক্ষিত। তারা টলস্টয় পড়ছে বা পড়ে ফেলেছে। এই সেন্ট পার্সেন্টের জন্য, সে বলল, ধর আমাদের দেশে লোকসংখ্যা ২২ কোটি। তাহলে আমাদেরকে ২২ কোটি বই ছাপতে হবে। এটা করলে আমাদের রাষ্ট্র চালানোর টাকা থাকবে না। কী অদ্ভুত কথা! কারণ, সেখানে ওই পরিশ্রুতিটা হয়েছে। সেখানে মফস্বল ও শহরের প্রশ্ন ওঠে না। এমনকি যখন অনগ্রসর দেশ ছিল, তখন পর্যন্ত মস্কো বলে একটা শ্রেণীর নাম করা হতো না, অজস্র শ্রেণীর নাম করা যেত। আজকে যদি তুমি ইংলিশ কালচারের কথা বল, সাহিত্যের কথা বল_ তবে কি তোমাকে লন্ডন শহরের কথা বলতে হবে? নাকি লন্ডন শহরে যা হয় ম্যানচেস্টারেও তা-ই হয়? সব জায়গাতেই তা-ই হয়? তাহলে তোমার প্রশ্ন ছিল এই যে, ঢাকাকেন্দ্রিক কেন? তাহলে আমি বলব যে, সত্যি সত্যি এখানে শিক্ষার বিস্তার হয়নি, এখানে সংস্কৃতির বিস্তার হয়নি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তারের মধ্য দিয়ে সমাজের যে কাঠামোটা দরকার তা আমরা করিনি, তা আমরা ভাবিনি, তা আমরা করতে চাইনি এবং চাই না। এখন কেউ যদি মফস্বল ও রাজধানীর এই বিভাজনের কথা বলে, তখন আমি বলব_ এটাই গ্রাম্যতা। সত্যিকারের নাগরিকতা ওইসব দেশে; আমাদের এখানে এটাই গ্রাম্যতা। ষআপনি রাজনীতি দ্বারা তাড়িত। জীবনভর এ দেশের রাজনীতির যে পরিবর্তন চেয়েছেন, তার ফলাফল দেখে কি আপনি তৃপ্ত? ষষমোটেই না, একেবারেই না। ষকেন তৃপ্ত নন? ষষতৃপ্ত নই এই কারণে যে, আমাদের রাজনীতি করার কারণটা কী ছিল? আমি যে রাজনীতিতে পুরোপুরিভাবে সচেতন হওয়া এবং যতটুকু পেরেছি সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছি_ তার কারণ তো একটা ছিল। কারণটা হচ্ছে, রাজনীতি ছাড়া কোনো মানুষ হয় না; নেই। জন্তু-জানোয়ার থাকতে পারে যাদের কোনো রাজনীতি নেই, কিন্তু রাজনীতি ছাড়া মানুষ হয় না। রাজনীতি করে তুমি যদি মনে কর দেশটাকে লুট করবে, দেশের জনগণের ওপর ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, দেশটাকে শাসন করবে এবং সেই কারণে যত রকম পন্থা আছে, সবই তুমি অবলম্বন করবে; তাহলে সেই রাজনীতির জন্য তো আমি রাজনীতি করিনি। আমারও রাজনীতি করার একটা বিশেষ কারণ ছিল। আমি নিশ্চয়ই সব জিনিসটাকে ধাপে ধাপে ভাগ করে নেব যে, এ মুহূর্তে কী করব, এক বছরের জন্য কী করব, ১০ বছরের জন্য কী করব ইত্যাদি। ১০ বছরে তো অনেক কিছুই বদলে যেতে পারে। পঞ্চাশের দশকের রাজনীতি ছিল আমরা স্বায়ত্ত শাসন চাই। বিদেশি যে চুক্তিগুলো আছে তা থেকে মুক্তি চাই। তার মানে, রাজনীতি করার পেছনে আমাদের একটা সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। গোটা দেশ তখন আমাদের সমর্থন করেছিল। সেই সময়ে আমরা মনে করেছি, ভুল তত্ত্বের ভিত্তিতে আমাদের এই দেশ ভাগ হয়েছে। মানে দ্বি-জাতিতত্ত্ব। মুসলমানরা তো কোনো জাতি নয়; সম্প্রদায়। কী রকম ভুল তত্ত্ব দেখ! ধর, ইরানিয়ানরা কি মুসলমান নয়? তারা জাতিতে কি আরব না? আবার আরবরা কি জাতি নয়? তারা কি তুর্কি? আবার দেখ তারা কিন্তু মুসলমানও। তাহলে জাতি আর ধর্ম এক হবে কী করে? এটা গুলিয়ে ফেলা হয়েছিল ভুল রাজনীতি করতে গিয়ে। কাঁধে দড়ি দিয়ে ঘানিতে যেমন বলদকে ঘোরায়, বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কাঁধে দড়ি দিয়ে ঘোরানো হয়েছিল। তার ফল কী হলো, তা তো তোমরা জানোই। তা-ই যদি হতো, তাহলে মুসলমানের দেশে তো একটাও হিন্দু থাকা উচিত না, আর হিন্দুদের দেশে তো একটাও মুসলমান থাকা উচিত না। অথচ দেখ, এখনও বাংলাদেশে যত মুসলমান আছে; প্রায় তত মুসলমান ভারতে আছে। কিন্তু কেন? তার মানে ভুল রাজনীতি। অতঃপর দেশ ভাগ হলো। তারপর আমরা যখন দেখলাম, এই দেশটা কোনো একটা স্বাধীন দেশের অংশ নয়। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ আলাদা করা হয়েছে, অথচ দেশটা একভাবে শাসিত হচ্ছে না। তখন আমরা দেখলাম, মূলত আমাদের দেশ একটা উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। তখন এটার বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়ালাম। ছাত্ররা ঘুরে দাঁড়াল। ওটা ছিল আমাদের তখনকার রাজনীতি। কিন্তু সেটার সঙ্গে এখনকার রাজনীতি তুলনা কর! সেই ছাত্র রাজনীতির কথা মনে করে আজকের ছাত্র রাজনীতি দেখলে লজ্জা, ঘৃণায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়। কী করছ তোমরা ছাত্র রাজনীতির নামে, যুব সম্প্রদায়ের নামে! তাহলে আমি যদি বলি, এদের মধ্যে দেশ বলে কোনো ভাবনা নেই_ তাহলে কি আমার অন্যায় হবে? তোমাদের এই অবস্থায় আমি তোমাদেরকে তারুণ্য বলে স্বীকার করে নেব? শুধু রাজনীতি কেন, যারা সাহিত্য করছে তারা নিজেদের দেশের দিকে না তাকিয়ে বলছে যে, আমরা এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বশেষ যে সমস্ত মতবাদ এসেছে তাকেই গ্রহণ করব। তাহলে তো এটা অপমান করা হয় আমাদের দেশকে! এই যদি মানসিকতা হয়, তাহলে আমি আবার বলছি, আমি এটাকে পরিত্যাগ করি। ষতাহলে দেশের রাজনীতি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে না পেঁৗছার পেছনে আপনাদের মতো যারা বুদ্ধিজীবী আছেন, তাদের ব্যর্থতাও ছিল? ষষআমি যা বলেছি, তাতে তো সবই স্পষ্ট। আমাকে কি নাম করে করে বলতে হবে? ব্যর্থতা যদি বল, তবে বুদ্ধিজীবীদের কথা বলবে না কেন? রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা নয় কেন? শিক্ষক সমাজের নয় কেন? শিল্পী-কবি-সহিত্যিকদের নয় কেন? আমি আমার দায়কে অস্বীকার করব কেন? এই ব্যর্থতা সবার। ষবই পড়ে আলোকিত মানুষ হওয়ার কথা বলা হয়। আসলেই কি বই পড়ে আলোকিত মানুষ হওয়া যায়? যে কৃষক জীবনে কোনো বই পড়েনি, অথচ সে বারো রকমের ধান উৎপাদন করছে। তার উৎপাদিত শস্যের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতি টিকে আছে। তাহলে সে কি আলোকিত মানুষ নয়? আসলে এর দার্শনিক ব্যাখ্যা কী? ষষমজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ কথা বলতে জানে। বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের তফাত এখানেই। মানুষ যখন কথা বলে তার সব কথাই কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষ কিছু কথা বলে কিছু কথা না বলার জন্য। অর্থাৎ একটা কথা বলবে না বলেই একটা কথা বলছে। তার মানে, মানুষ কথা বলছে কথা বলার জন্য এবং কথা চাপা দেওয়ার জন্য। দু'ভাবেই কথা বলে মানুষ। কাজেই আলোকিত মানুষ ব্যাপারটাও কথা না বলার জন্য একটা কথা। যে শস্য উৎপাদন করে সে তো নিজেই আলোকিত। সে আলো ছড়ায়। তাকে যদি এসব কথা বল, সে শুনে বলবে, তাকে বুঝি ঠাট্টা করা হচ্ছে। বলা উচিত, এমন একটা মানুষ দরকার যে আলো ছড়িয়ে দিতে পারে। যেমন সলিমুল্লাহ খান খুব মজা করে বলেছেন, তাহলে কি আমরা 'লোক' থেকে 'অলৌকিকে' যাব, 'আলো' থেকে 'আলৌকিকে' যাব? আসলে এসব 'আলোকিত মানুষ' একটা উপমা, মেটাফোর। মেটাফোরের অর্থ নানাভাবে করা যায়। আলোকিত লোক ছাড়া সমাজের উন্নতি হবে না_ এ কথা দিয়ে তো নির্দিষ্ট কিছু বোঝায় না। এসব কথা আমি বলিও না কখনও। ষতার মানে, সর্বক্ষেত্রে বই মানুষকে আলোকিত করে না? ষষসেটা বলা মুশকিল। কী বই পড়ছ সেটা দেখতে হবে। বই পড়ে ঘন অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাবে_ এমন বইও তো আছে! ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করবে এমন বই কি নেই? তা যদি হয়, যে আদৌ বই পড়েনি সে আলোকিত হতে অসুবিধা কী আছে? কারণ, সে তো শিখছে। বই পড়ে যা শিখবে, তার চাইতে অনেক বেশি শিখছে সে প্রকৃতি থেকে। বেঁচে থাকার ভেতর দিয়ে সে শিখছে। যদি তুমি বড় লোকের ছেলে হও, সারাদিন তুমি বই পড়ে এমন অলস হয়ে যাবে যে, তুমি কিছুই করতে পারবে না। মধু অতিরিক্ত খেলে কিন্তু নেশা হয়। বই পড়ার নেশা হলে, বইয়ের পোকা হয়ে গিয়ে একদম অপদার্থ হয়ে যায় মানুষ_ এ কথাটাও কিন্তু বলা যেতে পারে। বই পড়ে যেমন আলোকিত হয় মানুষ, একইভাবে বই পড়ে মানুষ স্বপ্নভুক, অপদার্থ হয়ে যেতে পারে। আমার এক বড় ভাই শুধু বই পড়ে, কিন্তু তার কোনো সামাজিকতা ছিল না, কোনো শারীরিক অ্যাক্টিভিটিস ছিল না। তাহলে সে তো বই পড়ে আলোকিত হলো না। তুমি বই পড়ে কী আনবে? তুমি যদি মৌমাছি হও তবে ফুলে বসে মধু আনবে, আর যদি মাকড়সা হও তবে বিষ আনবে। তুমি যদি বই পড়ে মস্তিষ্ক চালিত কর, তবে বই পড়ে লিখতে পারবে, আবার একই সঙ্গে অপদার্থও হতে পারবে। ষবাংলাদেশের কথাসাহিত্যে এখন যারা কাজ করছে তাদের লেখালেখি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? আপনি কি কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন? ষষতুমি যেভাবে প্রশ্ন করছ, তাতে সব প্রশ্নকে দু'ভাগে ভাগ করতে হবে। হোয়াইট, ব্ল্যাক। সাদা আর কালো। নীল, ঘন নীল, হালকা নীল, মোটামুটি নীল, প্রায় নীল_ কত চাও? কাজেই তুমি যদি বল যে, আপনি কি আশাবাদী? আরে মহা মুশকিল! কত ভালো লেখা হচ্ছে, কত বাজে লেখা হচ্ছে, কত আবর্জনা লেখা হচ্ছে, কত ঝকঝকে লেখা হচ্ছে। হচ্ছে তো! গড় একটা হিসাব মানুষ অনেক সময় করতে যায় বটে। গড় হিসাব করাটা অনেক সময় ঠিকও না, অনেক সময় ঠিকও। আবার গড় করে অনেক সময় মনে হয় বা দেখতে পাই_ ধর আল, আল মানে লাটিমের যে আল সেটা নড়ে গেলে কিন্তু লাটিমটা নড়বড়-নড়বড় করে ঘোরে। কিন্তু যেভাবে ঘোরার কথা সেভাবে ঘোরে না। রাজনীতি বল কি সাহিত্য বল, সেই আলটা থাকতে হবে। লেখক যারা তাদের একটা আল থাকা দরকার। সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যের সেই আলটা যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে। এর কারণটা নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। বিশ্বের যে ওয়েগুলো আছে, সাহিত্যের যে ওয়ে, ঢেউগুলো আছে_ এটা একটা জায়গা। আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি নড়বড়ে_ সেটা আরেকটা জায়গা। আমাদের স্থির একটা জায়গায় গিয়ে একটা পরিচয় ঠিক করা_ সেটা একটা জায়গা। ভবিষ্যতে সমাজে কী করব না করব, কেমন মানুষ হবো, কেমন মানুষ হওয়া দরকার, এসব চিন্তার বড় অভাব। এ রকম অজস্র কারণ দেখা যায় যে, আলটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে এটা আমার মনে হয়। কিন্তু লেখক হিসেবে যখন আমাকে প্রশ্ন করা হয়_ আপনি কি আশাবাদী, নাকি নিরাশাবাদী_ এই প্রশ্নের দরকার নেই। আমি বহু রকম ভালো লেখা দেখছি, বহু প্রতিভা দেখছি, বহু আশা দেখছি। আবার একই সঙ্গে বহু জঞ্জালও দেখছি, বহু হতাশাও দেখছি। সুতরাং নো অ্যাডভাইস। কোনো উপদেশ দেব না। আমি নিজেও হয়তো ভুল করছি। আমি কথাগুলো ঠিক বলছি কি-না তাও জানি না। কারণ, আমি একটা জিনিস ঠিক করেছি_ কাউকে উপদেশ দেব না। তুমি নিজেই করে নাও না কেন? ষইদানীং কোনো কোনো উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই প্রমিত বাংলা এবং আঞ্চলিক বাংলাকে এক করে ফেলা হয়। একটা জগাখিচুড়ি ভাষা। সংলাপ আঞ্চলিক থাকতে পারে, কিন্তু লেখকের বর্ণনা তো প্রমিত হওয়া চাই। নাকি? কিংবা হলে দুটোই আঞ্চলিক হোক, তাতেও ক্ষতি নেই। কিন্তু বর্ণনার মধ্যে এই যে মিশ্রণ, এটা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর কি-না? ষষসংলাপে তো আঞ্চলিকতা থাকতেই পারে। সেটা নিয়ে বৃথা তর্ক করার কোনো দরকার নেই। মান ভাষা নিয়ে, মান ভাষার প্রয়োজন নিয়েও কথা বলার দরকার নেই। বা এটাও বলার দরকার নেই যে, মান ভাষার দরকার নেই। মোট কথা হচ্ছে, আমরা বিনা কারণে ভাষা নিয়ে অনর্থক তর্ক তৈরি করছি। আমার চোখটা যথেষ্ট পরিমাণে স্বচ্ছ থাকলে এসব তর্ক আমরা করতাম না। আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে মান ভাষার কোনো বিরোধ খুঁজে পাওয়া যেত না, বিরোধ দেখা যেত না। চিরকালীন সত্য বলে তো কিছু নেই। কথা হচ্ছে, যেটা আমাদের গৃহীত ভাষা সেটা আমাদের প্রয়োজন আছে কি-না? ইতিমধ্যেই যদি তোমার মতো তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি সেটা করতেই পার। যেটা তুমি বলেছ যে, মান ভাষার মধ্যে একটুখানি আঞ্চলিক ঢুকিয়ে দেওয়াটা। আমার কথা হচ্ছে, অনর্থক তৎসম শব্দ ব্যবহার না করে যতটুকু পারা যায় মুখ-চলতি শব্দ ব্যবহার করা। এটা আমি এখন একটা প্রধান আদর্শ বলে মনে করি। আমার গদ্য যিনি পড়বেন তিনি দেখবেন, আমি 'গ্রহণযোগ্যতা' ব্যবহার না করে 'মেনে নেওয়া' ব্যবহার করছি। 'পরিচালনা'র বদলে আমি 'চালিয়ে নেওয়া' বলি। ছোট ছোট হাইফেন দিয়ে লিখি। আমার পাঠক এগুলো খেয়াল করে কি-না জানি না। আমি চাই তারা এগুলো খেয়াল করুক। তৎসম শব্দ ব্যবহার করলে একটা লফ্জ লফ্জ ভাব এসে যায়। যেমন আমি এভাবে বলি না, 'আমাদের আজ এই লক্ষ্যে অমুক কাজ করতে হবে'। আমি 'লক্ষ্যে' শব্দটা বলি না। আমি বলি 'এই জন্যে'। 'এই লক্ষ্যে' আবার কিসের? আমি বলব 'এই কারণে' কাজ করছি। আমি কেন সহজ করব না? আমি কেন দৈনন্দিন ভাষাতে আমার লেখাকে নামিয়ে আনব না? ভাষার কিন্তু নিজস্ব একটা অভ্যেস থাকে। যেমন অভ্যেস_ 'এ বিষয়ে আমার অবস্থান দৃঢ়।' এটা কিন্তু বহুদিন ধরে চলে আসছে। এটা একটা চল হয়ে গেছে। আমি চেষ্টা করি এসব চল ভেঙে দিতে। ভেঙে দিলে দেখি না কেমন হয়! তুমি যেটা জানতে চাইলে সেটা নির্ভর করে লেখকের বলার ভঙ্গির ওপর। যেমন এক জায়গায় বলে, 'একেবারে সোজা দৌড় লাগাল'। আরেক জায়গায় বলে 'দৌড় ধরল'। 'দৌড় ধরল' ব্যবহারে কিন্তু আপত্তি নেই। কিন্তু আমার কানে লাগছে। তাই এটা যে বিশাল একটা অপরাধ হয়ে গেল ভাষার ক্ষেত্রে, এটা কিন্তু নয়। আমার যেমন উচ্চারণের ক্ষেত্রে 'র' এবং 'ড়' এটার মধ্যে তফাত হয়ে যায়। আমাদের রাঢ় দেশের ঐতিহ্য এই ভুলটা। 'আমরা'কে আমরা 'আমড়া' বলি। এটা আমাদের ওদিকের দোষ। এসব থাকে। তো 'দৌড় ধরল' এবং 'দৌড় লাগালো'র মধ্যে হয়তো তেমন তফাত নেই। কিন্তু হয়তো যারা অনেক দিন ধরে দৌড় লাগাল, দিলে একখানা দৌড়, টেনে দৌড়_ এসব দ্বারা অভ্যস্ত, তাদের জন্য 'ধরে দৌড়' ব্যবহার করতে গেলে একটু অসুবিধায় পড়ে। এ ক্ষেত্রে আমার কোনো অ্যাডভাইস নেই। কিন্তুমান ভাষাতেই গল্প লিখতে গিয়ে 'হয়্যা গ্যাল' যখন বলা হলো, তখন আমার অসম্ভব বিরক্তি লেগে গেল। এটা তো দরকার নেই। এটা করে আমি কী অ্যাটিচিউড করছি? কী বোঝাতে চাচ্ছি? লেখার তো একটা স্ট্যান্ডার্ড থাকা চাই। এসব মানুষকে অভ্যেস করানো যাবে বলে মনে হয় না। কথ্য ভাষার তো বহু রূপ আছে। তার তো শেষ নেই। মুখের ভাষাতেও তাই। আমার লেখা সম্পর্কে কোনো এক লেখক উল্লেখ করেছিলেন, "হাসানের এক জায়গায় আছে যে, খান্দের বাড়িতে ধান সেদ্ধ হচ্ছে, আলোটা যখন ধপ করে জ্বলে উঠছে, তখন খান্দের বাড়ির সোন্দর সোন্দর মুখগুলো ভেসে উঠছে। কিংবা যেমন, তুই কি আজকাল তোর শ্বশুরবাড়ি যাস? বলে, হ্যাঁ যাই তো। বলে, শালী আছে সে জন্য যাস তাই না? বলে, হ্যাঁরে, আমার শালী যে সোন্দর তা আর কলাম না। অর্থাৎ এত সুন্দর তা সে আর বলছে না। সেখানে ওই যে 'কলাম না' শব্দটা কী অসাধারণ অভিব্যক্তিই না বোঝায়।" তো ভাষার এই ব্যবহারটা নির্ভর করে যে ব্যবহার করছে তার ওপর এবং যে পড়ছে তার ওপর। পড়ার পর যদি মনে হয় ঠিক জায়গায় হয়েছে, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। যদি তুমি গান গাও, যদি তোমার তবলা থাকে, দেখবে, তবলার কিন্তু সোম থাকে। আঙ্গুলটা সোমে পড়তে হয়। সোমে না পড়ে যদি তোমার মাথায় পড়ে তাহলে তো রাগ করবে, নাকি? করবেই তো। গানের কোনো ক্ষতি হলো কি? হলো না। কাজেই শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তুমি সোমে মারছো নাকি মাথায় মারছো_ এই ব্যাপারগুলো তোমাকেই ঠিক করতে হবে। তুমি যে বাক্যটার কথা বললে, সেটা ভালো নাকি খারাপ, তা সাধারণভাবে বলা যাবে না। ওই বাক্যটা পড়ার পরে নিজেই নিজেকে বিচার করবে_ এটা ভালো, না খারাপ। ষপ্রেম সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? প্রেম কি আসলে দৈহিক, নাকি প্লেটোনিক কোনো ব্যাপার? এর দার্শনিক ব্যাখ্যা কী? সাহিত্যচর্চার জন্য প্রেম আসলে কতটা জরুরি? ষষসেদিনই একজন আমাকে বলল, স্যার আপনার তো অনেক রকমের বই বের হলো, আমি আপনার একটি 'প্রেমের গল্প'র বই বের করতে চাই। আমি বললাম, প্রেম বলতে তোমরা যা বোঝ তার একটাও আমি লিখিনি। তবুও সে আমাকে জোর করে ধরল। তারপর আমি বললাম, আমার এই বইয়ের নাম দাও 'প্রেম-অপ্রেমের গল্প'। কারণ, আমার সব গল্পই প্রেমের; আমার একটা গল্পও অপ্রেমের নেই। আবার প্রেম বলতে এখন যা বোঝায় সেই প্রেম আমার গল্পে নেই। সুতরাং বইয়ের নাম হোক 'প্রেম-অপ্রেমের গল্প'। ষআপনার প্রশ্নের অর্ধেক উত্তর পেয়ে গেছি। কিন্তু নারী-পুরুষের যে প্রেমের ব্যাপারটা...? ষষশোনো, প্রেম কদ্দিন থাকে জানো? সাত দিন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম সাত দিন থাকে। তারপর তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়। প্রথম সাত দিন শরীরে নানা রকম কেমিক্যাল সিক্রিয়েশন হয়। তখন অদ্ভুত অদ্ভুত ভালো লাগার সৃষ্টি হয়। তারপর এক সময় দেহ থাকে আবার থাকে না। মানে দেহ না থাকলেও প্রেম থাকে। প্রেমের ব্যাপারে কেনো সংস্কারই আমার মধ্যে কাজ করে না। তবে, প্রেম এবং দেহজ কামনার দেহ মিলনের যে বাসনাটা_ আমি কোনো কোনো জায়গায় তা আলাদা করতে পারি। আমি করতে চাইও। তখন সেটাকে বিশুদ্ধ প্রেম না বলে নানা রকমের বন্ধনের একটা জায়গা বলি না কেন? যেটাকে মান্য না করলে, লঙ্ঘন করলে স্রেফ দেহ আছে বলে যে কথাটা_ সেটা এসে যায়। যেমন বেশ্যালয়ে গিয়ে কি প্রেম করার দরকার আছে? দরকার নেই। অথচ যার সঙ্গে আমার প্রেম তার সঙ্গেও আমরা মিলনে যাই এবং বিচিত্র প্রেম অনুভব করি। তো সে ক্ষেত্রে আত্মিক প্রেম-টেম এসব কথা অমূলক। তুমি আত্মিক প্রেমের কথা বললে। আত্মা আছে কি নেই সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। আসলে প্রেমের ধারণাটার সঙ্গে বহুগামিতার বিরোধ আছে কি-না? নেই। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস কত নারীর সঙ্গে দেহসংসর্গ করেছেন তার হিসাব নেই। তার মানে কি তিনি সবার সঙ্গে প্রেম করেছেন? করেননি। তার 'প্রেম ও কলেরা' বইতে দেখ, প্রেমিকের সঙ্গে দেহ-মিলন যখন ঘটে, তখন তারা প্রায় ৮০ বছর বয়সের। প্রায় ৮০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রেমিককে; যখন তার শরীরের পেশি ঝুলে পড়েছে, প্রেমিকার স্তন, ঠোঁট, গলা, কান_ এসব ঝুলে পড়েছে। মার্কেসের কী ভয়াবহ লেখা! কত রকম বৈচিত্র্য তার লেখার! তো মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কত রকমের বৈচিত্র্য যে আছে তার হিসাব নেই। মহাকাব্যগুলোতে দেখ, প্রেমের কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা নেই। দ্রৌপদীর সঙ্গে কার প্রেম ছিল? সুতরাং ব্যাপারটাকে এভাবে নাও। সাদা, কালো, দেহজ প্রেম বা প্লেটোনিক প্রেম_ এভাবে আলাদা করার কোনো দরকার নেই। ষজীবনের অনেক পথ পেরিয়ে এসেছেন। এখন কি আপনাকে মৃত্যুভাবনা তাড়িত করে? ষষনা; মোটেই না। ওই নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন নই। ষআসলে লেখক হিসেবে আপনি কতটা সার্থক বা তৃপ্ত? কিংবা ব্যক্তিজীবনে আপনি কতটা তৃপ্ত? আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি কী? ষষলেখক হিসেবে আমি তৃপ্ত নই। এ ক্ষেত্রে অতৃপ্তি তো আছেই। আর ব্যক্তিজীবনে আমার মনে হয় না, আমার যা প্রাপ্য তা আমি পাইনি। কাজেই আমি এ ক্ষেত্রে অতৃপ্ত নই।

হাসান আজিজুল হক বললেন 'রাজনীতি ছাড়া কোনো মানুষ হয় না' হাসান আজিজুল হক বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান লেখক, বাঙালি জীবন ও সমাজের সার্থক রূপকার। ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবাংলার বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিবিষ্ট কথাসাহিত্য চর্চায়। লেখার মধ্য দিয়ে সমাজ বাস্তবতার চিত্র ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি, মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি চেয়েছেন এবং ব্যক্তি মানুষকে স্বাধীন হিসেবে দেখতে চেয়েছেন সারাজীবন। কথাশিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বকৃত নোমান স্বকৃত নোমান :জীবনের প্রায় পুরোটা সময় আপনি কেন্দ্র থেকে দূরে থাকলেন। এই দূরে থাকাটা আপনার ভেতরে কোনো অভাববোধ বা শূন্যতা কাজ করেছে কি-না? আপনি কি মনে করেন, কেন্দ্রে থাকলে আরও ভালো করতেন? হাসান আজিজুল হক :এক কথায়, এক শব্দে জবাব দিই_ না। ষআমাদের শিল্প-সাহিত্য এখন অনেকটা ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। যারা প্রান্তে থেকে শিল্প-সাহিত্য চর্চা করছেন তারা এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগেন_ প্রান্তে থেকে বুঝি কিছুই হয় না; কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠা লাভ সম্ভব হয় না। তাই সবাই কেন্দ্রের দিকে ছোটে। আবার কেন্দ্রে যারা আছেন তারাও ভাবেন, প্রান্তে যারা আছেন তাদের বুঝি কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তবতা তো ব্যতিক্রম। আমরা অনেককেই দেখি, যারা প্রান্তে থেকেও কেন্দ্রের চাইতে অনেক ভালো করেছেন। সামগ্রিক ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার কী মতামত? ষষএই মনোভাব আসলে এক ধরনের গ্রাম্যতা। মফস্বলে যারা আছে তারা মফস্বলে আছে বলেই তাদের কোনো রকম এক্সপোজার নেই; আর রাজধানীতে আছে বলে এদের এক্সপোজার আছে_ মূল ব্যাপারটাই গ্রাম্যতা। গোটা দেশের লোকের মনের মধ্যে এ ধরনের একটা ব্যাপার আছে যে, যা কিছু করতে হবে সব ঢাকাতেই করতে হবে। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব রয়েছেন, যারা বলেন, জীবনের সবকিছু ছেড়ে দেব, কিন্তু ঢাকা কোনোদিন ছাড়ব না। আমার কাছে মূলত মনে হয়, এই মনোভাবটাই হচ্ছে গ্রাম্যতা। কোনো উন্নত জায়গা তথা উন্নত দেশে এই মফস্বল ও রাজধানীর পার্থক্য হয় না। হয় না এই জন্য, ওখানে যে সংস্কৃতি, যে সাহিত্য বা শিল্পটা তৈরি হয়_ নানা স্তরে তার মালিকানা ভাগ হয়ে গেছে। আমাদের এখানে তাই চলছে। আমাদের এখানে নানা সিঁড়ি আছে। একেক সিঁড়িতে একেকজনের অবস্থান। আমাদের এখানে বড়লোকদের কোনো সিঁড়ি নেই। অর্থাৎ তাদের কোনো সংস্কৃতিও নেই; দরকারও হয় না, ধারও ধারে না তারা। বিশেষ করে একালে যারা খুব বড়লোক হয়েছে তাদের বড়লোক হওয়ার পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া সম্বন্ধে আমি মন্তব্য করার কোনো প্রয়োজন মনে করি না। কারণ, এটা বাংলাদেশের সবার সামনে দিবালোকে ডাকাতির মতোই পরিষ্কার। তাই এটা নিয়ে কিছু বলার নেই। তাহলে আমাদের বাকি যে সংস্কৃতিটা, যাকে মূলত একটু উচ্চবিত্ত শ্রেণী বলা যায়, সচ্ছল মধ্যবিত্ত বলা যায় এবং টেনেটুনে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত বলা যায়। এটা হচ্ছে খাঁটি, নির্মম, বাস্তব সত্য কথা। আমরা যারা কাজ করছি, এই সীমাবদ্ধতা বুঝে চলি। আমরা যখন গ্রামীণ সংস্কৃতির জন্য আফসোস করি, আক্ষেপ করি, ফিরিয়ে আনতে চাই_ সেটাও কিন্তু মূলত একটা রোমান্টিক জায়গা থেকেই চাই। সেটা বিমূর্ত একটা জায়গা থেকে তা আমরা করি। যেটা বাস্তবে কখনোই অনুভব করি না। তারপর যেটুকু চর্চা গ্রামীণ সংস্কৃতির জন্য কিংবা আমাদের চিরকালীন ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত-নাটক ইত্যাদি যেটুকু আমরা প্রকাশ করি, এটা কিন্তু বাস্তব মধ্যবিত্তের জায়গা থেকেই করি। মধ্যবিত্তেরই আফসোস এটা। এবং মধ্যবিত্তই এটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে; যে জিনিসটা কখনোই কার্যকর হবে না। এ সমস্ত দোষ আমাদের সমাজে শেষ নেই। আমরা যা কিছু করি তা সবার নয়। হাসান আজিজুল হক যতই জনগণের জন্য লিখে থাকুন না কেন, জনগণ তার পাঠক নয়। আমার সমস্ত সম্বোধন শেষ পর্যন্ত গিয়ে আমার শ্রেণীর লোকের কাছেই আসে। এই নির্মম সত্যটা মেনে নিয়ে, এর সীমাবদ্ধতাটা স্বীকার করে নিয়ে আমি লেখক হয়েছি। আমি তবু মনে করি, এটা একেবারেই বৃথা যাবে না। নিশ্চয়ই যাবে না। কেননা, সমাজ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকছে না। বিত্ত বাড়ছে আর বহু লোক নিজেদের শ্রেণীকে পরিত্যাগ করে আসছে এবং যাবে। যেটাকে বলে, বালির মধ্যে যদি পানি ঢালো, তবে পানিটা পরিশ্রুত হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় নিচে যায়। এ রকম কোনো একটা পদ্ধতিতে জনগণের কাছ পর্যন্ত একটা জিনিস পেঁৗছুবে_ এই আশা যদি না করতাম, তাহলে হয়তো লেখক হতে পারতাম না। কাজেই তুমি ঢাকাকেন্দ্রিকতার প্রথম যে প্রশ্ন করলে, যে প্রশ্নের জবাব এক কথায় দিয়েছিলাম_ না। তার কারণ, পুরো অবস্থাটাকে আমি পরিত্যাগ করি। আমরা যখন সহানুভূতির মন দিয়ে ওই গ্রামের মানুষদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য গ্রামে যাই, বক্তৃতা করি, তখন আসলে অহংবোধ কাজ করে। আমি যখন বলি, আমার গ্রামীণ সংস্কৃতি বা আমার বাংলা গানের কী বৈভব ছিল! তাই জারিগানের দলটাকে বরিশাল থেকে শহরে নিয়ে এসেছি, বা আমাদের সাঁওতালদের নাচটা কেমন ছিল তা দেখার জন্য নিয়ে এসেছি শহরে। এটা কিন্তু আসলে এক ধরনের প্রদর্শন। এটা কিন্তু তাদের জীবনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে যুক্ত নয়। গ্রামগুলো কিন্তু মরে গেছে। সাঁওতাল গ্রামগুলো তো মৃত গ্রাম। আমি এক জায়গায় বলেছি, সেখানে শুয়োরেরও স্বাস্থ্য খারাপ! সেখানকার হাঁসের স্বাস্থ্য খারাপ, ছাগল এবং গরুগুলোও শীর্ণ। দারিদ্র্য তাদের বহু দূরে নিয়ে গেছে। সেখানে বিশ্বব্যাংকের হিসাব, সরকারের হিসাব, বুদ্ধিজীবীদের হিসাব কিছুই যে মেলে না_ এ কথাগুলো কে বোঝাবে! ড. মুহাম্মদ ইউনূস যতই করুন না কেন, কিছুই হচ্ছে না। মাংস ওভাবে লাগে না। গায়ে মাংস লাগাতে গেলে পুষ্টিটা সমস্ত শরীরে যেতে হবে। নিজের সম্বন্ধে এ কথাটা বলা যায়। যদিও সেসব সমাজে এক ধরনের শোষণের রূপ আছে, শ্রেণী বিভাগ আছে। তুমি বলতে পার আমেরিকা বা রাশিয়ার মতো দেশেও আছে। কিন্তু সেখানে যেটা বলেছিলাম_ এক ধরনের পরিশ্রুত হয়ে তলা পর্যন্ত পেঁৗছেছে। সম্প্র্রতি রাশিয়ান এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। বললাম, তোমরা এত করতে পার, তোমাদের প্রকাশনা থেকে বাংলায় কত রাশান গ্রন্থের অনুবাদ করছ। কিন্তু টলস্টয়ের অনুবাদ করাও না কেন? 'ওয়ার অ্যান্ড পিস'-এর অনুবাদ হয় না কেন? করলে তো আমরা পড়তে পারতাম। আমরা তো সঠিক অনুবাদ করতেও পারি না। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য যে টলস্টয়ের অনুবাদ করেছিলেন, সেটা প্রকৃত অনুবাদ নয়। তোমরা কেন কর না? উত্তরে সে বলল, বাংলা ভাষায় বের করা তো দূরের কথা, আমরা রাশানও করি না। তার কারণ, আমাদের দেশের লোক সেন্ট পার্সেন্ট শিক্ষিত। তারা টলস্টয় পড়ছে বা পড়ে ফেলেছে। এই সেন্ট পার্সেন্টের জন্য, সে বলল, ধর আমাদের দেশে লোকসংখ্যা ২২ কোটি। তাহলে আমাদেরকে ২২ কোটি বই ছাপতে হবে। এটা করলে আমাদের রাষ্ট্র চালানোর টাকা থাকবে না। কী অদ্ভুত কথা! কারণ, সেখানে ওই পরিশ্রুতিটা হয়েছে। সেখানে মফস্বল ও শহরের প্রশ্ন ওঠে না। এমনকি যখন অনগ্রসর দেশ ছিল, তখন পর্যন্ত মস্কো বলে একটা শ্রেণীর নাম করা হতো না, অজস্র শ্রেণীর নাম করা যেত। আজকে যদি তুমি ইংলিশ কালচারের কথা বল, সাহিত্যের কথা বল_ তবে কি তোমাকে লন্ডন শহরের কথা বলতে হবে? নাকি লন্ডন শহরে যা হয় ম্যানচেস্টারেও তা-ই হয়? সব জায়গাতেই তা-ই হয়? তাহলে তোমার প্রশ্ন ছিল এই যে, ঢাকাকেন্দ্রিক কেন? তাহলে আমি বলব যে, সত্যি সত্যি এখানে শিক্ষার বিস্তার হয়নি, এখানে সংস্কৃতির বিস্তার হয়নি। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তারের মধ্য দিয়ে সমাজের যে কাঠামোটা দরকার তা আমরা করিনি, তা আমরা ভাবিনি, তা আমরা করতে চাইনি এবং চাই না। এখন কেউ যদি মফস্বল ও রাজধানীর এই বিভাজনের কথা বলে, তখন আমি বলব_ এটাই গ্রাম্যতা। সত্যিকারের নাগরিকতা ওইসব দেশে; আমাদের এখানে এটাই গ্রাম্যতা। ষআপনি রাজনীতি দ্বারা তাড়িত। জীবনভর এ দেশের রাজনীতির যে পরিবর্তন চেয়েছেন, তার ফলাফল দেখে কি আপনি তৃপ্ত? ষষমোটেই না, একেবারেই না। ষকেন তৃপ্ত নন? ষষতৃপ্ত নই এই কারণে যে, আমাদের রাজনীতি করার কারণটা কী ছিল? আমি যে রাজনীতিতে পুরোপুরিভাবে সচেতন হওয়া এবং যতটুকু পেরেছি সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছি_ তার কারণ তো একটা ছিল। কারণটা হচ্ছে, রাজনীতি ছাড়া কোনো মানুষ হয় না; নেই। জন্তু-জানোয়ার থাকতে পারে যাদের কোনো রাজনীতি নেই, কিন্তু রাজনীতি ছাড়া মানুষ হয় না। রাজনীতি করে তুমি যদি মনে কর দেশটাকে লুট করবে, দেশের জনগণের ওপর ক্ষমতার অপব্যবহার করবে, দেশটাকে শাসন করবে এবং সেই কারণে যত রকম পন্থা আছে, সবই তুমি অবলম্বন করবে; তাহলে সেই রাজনীতির জন্য তো আমি রাজনীতি করিনি। আমারও রাজনীতি করার একটা বিশেষ কারণ ছিল। আমি নিশ্চয়ই সব জিনিসটাকে ধাপে ধাপে ভাগ করে নেব যে, এ মুহূর্তে কী করব, এক বছরের জন্য কী করব, ১০ বছরের জন্য কী করব ইত্যাদি। ১০ বছরে তো অনেক কিছুই বদলে যেতে পারে। পঞ্চাশের দশকের রাজনীতি ছিল আমরা স্বায়ত্ত শাসন চাই। বিদেশি যে চুক্তিগুলো আছে তা থেকে মুক্তি চাই। তার মানে, রাজনীতি করার পেছনে আমাদের একটা সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। গোটা দেশ তখন আমাদের সমর্থন করেছিল। সেই সময়ে আমরা মনে করেছি, ভুল তত্ত্বের ভিত্তিতে আমাদের এই দেশ ভাগ হয়েছে। মানে দ্বি-জাতিতত্ত্ব। মুসলমানরা তো কোনো জাতি নয়; সম্প্রদায়। কী রকম ভুল তত্ত্ব দেখ! ধর, ইরানিয়ানরা কি মুসলমান নয়? তারা জাতিতে কি আরব না? আবার আরবরা কি জাতি নয়? তারা কি তুর্কি? আবার দেখ তারা কিন্তু মুসলমানও। তাহলে জাতি আর ধর্ম এক হবে কী করে? এটা গুলিয়ে ফেলা হয়েছিল ভুল রাজনীতি করতে গিয়ে। কাঁধে দড়ি দিয়ে ঘানিতে যেমন বলদকে ঘোরায়, বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কাঁধে দড়ি দিয়ে ঘোরানো হয়েছিল। তার ফল কী হলো, তা তো তোমরা জানোই। তা-ই যদি হতো, তাহলে মুসলমানের দেশে তো একটাও হিন্দু থাকা উচিত না, আর হিন্দুদের দেশে তো একটাও মুসলমান থাকা উচিত না। অথচ দেখ, এখনও বাংলাদেশে যত মুসলমান আছে; প্রায় তত মুসলমান ভারতে আছে। কিন্তু কেন? তার মানে ভুল রাজনীতি। অতঃপর দেশ ভাগ হলো। তারপর আমরা যখন দেখলাম, এই দেশটা কোনো একটা স্বাধীন দেশের অংশ নয়। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ আলাদা করা হয়েছে, অথচ দেশটা একভাবে শাসিত হচ্ছে না। তখন আমরা দেখলাম, মূলত আমাদের দেশ একটা উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। তখন এটার বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়ালাম। ছাত্ররা ঘুরে দাঁড়াল। ওটা ছিল আমাদের তখনকার রাজনীতি। কিন্তু সেটার সঙ্গে এখনকার রাজনীতি তুলনা কর! সেই ছাত্র রাজনীতির কথা মনে করে আজকের ছাত্র রাজনীতি দেখলে লজ্জা, ঘৃণায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়। কী করছ তোমরা ছাত্র রাজনীতির নামে, যুব সম্প্রদায়ের নামে! তাহলে আমি যদি বলি, এদের মধ্যে দেশ বলে কোনো ভাবনা নেই_ তাহলে কি আমার অন্যায় হবে? তোমাদের এই অবস্থায় আমি তোমাদেরকে তারুণ্য বলে স্বীকার করে নেব? শুধু রাজনীতি কেন, যারা সাহিত্য করছে তারা নিজেদের দেশের দিকে না তাকিয়ে বলছে যে, আমরা এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বশেষ যে সমস্ত মতবাদ এসেছে তাকেই গ্রহণ করব। তাহলে তো এটা অপমান করা হয় আমাদের দেশকে! এই যদি মানসিকতা হয়, তাহলে আমি আবার বলছি, আমি এটাকে পরিত্যাগ করি। ষতাহলে দেশের রাজনীতি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে না পেঁৗছার পেছনে আপনাদের মতো যারা বুদ্ধিজীবী আছেন, তাদের ব্যর্থতাও ছিল? ষষআমি যা বলেছি, তাতে তো সবই স্পষ্ট। আমাকে কি নাম করে করে বলতে হবে? ব্যর্থতা যদি বল, তবে বুদ্ধিজীবীদের কথা বলবে না কেন? রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা নয় কেন? শিক্ষক সমাজের নয় কেন? শিল্পী-কবি-সহিত্যিকদের নয় কেন? আমি আমার দায়কে অস্বীকার করব কেন? এই ব্যর্থতা সবার। ষবই পড়ে আলোকিত মানুষ হওয়ার কথা বলা হয়। আসলেই কি বই পড়ে আলোকিত মানুষ হওয়া যায়? যে কৃষক জীবনে কোনো বই পড়েনি, অথচ সে বারো রকমের ধান উৎপাদন করছে। তার উৎপাদিত শস্যের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতি টিকে আছে। তাহলে সে কি আলোকিত মানুষ নয়? আসলে এর দার্শনিক ব্যাখ্যা কী? ষষমজার ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ কথা বলতে জানে। বন্যপ্রাণীর সঙ্গে মানুষের তফাত এখানেই। মানুষ যখন কথা বলে তার সব কথাই কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষ কিছু কথা বলে কিছু কথা না বলার জন্য। অর্থাৎ একটা কথা বলবে না বলেই একটা কথা বলছে। তার মানে, মানুষ কথা বলছে কথা বলার জন্য এবং কথা চাপা দেওয়ার জন্য। দু'ভাবেই কথা বলে মানুষ। কাজেই আলোকিত মানুষ ব্যাপারটাও কথা না বলার জন্য একটা কথা। যে শস্য উৎপাদন করে সে তো নিজেই আলোকিত। সে আলো ছড়ায়। তাকে যদি এসব কথা বল, সে শুনে বলবে, তাকে বুঝি ঠাট্টা করা হচ্ছে। বলা উচিত, এমন একটা মানুষ দরকার যে আলো ছড়িয়ে দিতে পারে। যেমন সলিমুল্লাহ খান খুব মজা করে বলেছেন, তাহলে কি আমরা 'লোক' থেকে 'অলৌকিকে' যাব, 'আলো' থেকে 'আলৌকিকে' যাব? আসলে এসব 'আলোকিত মানুষ' একটা উপমা, মেটাফোর। মেটাফোরের অর্থ নানাভাবে করা যায়। আলোকিত লোক ছাড়া সমাজের উন্নতি হবে না_ এ কথা দিয়ে তো নির্দিষ্ট কিছু বোঝায় না। এসব কথা আমি বলিও না কখনও। ষতার মানে, সর্বক্ষেত্রে বই মানুষকে আলোকিত করে না? ষষসেটা বলা মুশকিল। কী বই পড়ছ সেটা দেখতে হবে। বই পড়ে ঘন অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাবে_ এমন বইও তো আছে! ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করবে এমন বই কি নেই? তা যদি হয়, যে আদৌ বই পড়েনি সে আলোকিত হতে অসুবিধা কী আছে? কারণ, সে তো শিখছে। বই পড়ে যা শিখবে, তার চাইতে অনেক বেশি শিখছে সে প্রকৃতি থেকে। বেঁচে থাকার ভেতর দিয়ে সে শিখছে। যদি তুমি বড় লোকের ছেলে হও, সারাদিন তুমি বই পড়ে এমন অলস হয়ে যাবে যে, তুমি কিছুই করতে পারবে না। মধু অতিরিক্ত খেলে কিন্তু নেশা হয়। বই পড়ার নেশা হলে, বইয়ের পোকা হয়ে গিয়ে একদম অপদার্থ হয়ে যায় মানুষ_ এ কথাটাও কিন্তু বলা যেতে পারে। বই পড়ে যেমন আলোকিত হয় মানুষ, একইভাবে বই পড়ে মানুষ স্বপ্নভুক, অপদার্থ হয়ে যেতে পারে। আমার এক বড় ভাই শুধু বই পড়ে, কিন্তু তার কোনো সামাজিকতা ছিল না, কোনো শারীরিক অ্যাক্টিভিটিস ছিল না। তাহলে সে তো বই পড়ে আলোকিত হলো না। তুমি বই পড়ে কী আনবে? তুমি যদি মৌমাছি হও তবে ফুলে বসে মধু আনবে, আর যদি মাকড়সা হও তবে বিষ আনবে। তুমি যদি বই পড়ে মস্তিষ্ক চালিত কর, তবে বই পড়ে লিখতে পারবে, আবার একই সঙ্গে অপদার্থও হতে পারবে। ষবাংলাদেশের কথাসাহিত্যে এখন যারা কাজ করছে তাদের লেখালেখি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? আপনি কি কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন? ষষতুমি যেভাবে প্রশ্ন করছ, তাতে সব প্রশ্নকে দু'ভাগে ভাগ করতে হবে। হোয়াইট, ব্ল্যাক। সাদা আর কালো। নীল, ঘন নীল, হালকা নীল, মোটামুটি নীল, প্রায় নীল_ কত চাও? কাজেই তুমি যদি বল যে, আপনি কি আশাবাদী? আরে মহা মুশকিল! কত ভালো লেখা হচ্ছে, কত বাজে লেখা হচ্ছে, কত আবর্জনা লেখা হচ্ছে, কত ঝকঝকে লেখা হচ্ছে। হচ্ছে তো! গড় একটা হিসাব মানুষ অনেক সময় করতে যায় বটে। গড় হিসাব করাটা অনেক সময় ঠিকও না, অনেক সময় ঠিকও। আবার গড় করে অনেক সময় মনে হয় বা দেখতে পাই_ ধর আল, আল মানে লাটিমের যে আল সেটা নড়ে গেলে কিন্তু লাটিমটা নড়বড়-নড়বড় করে ঘোরে। কিন্তু যেভাবে ঘোরার কথা সেভাবে ঘোরে না। রাজনীতি বল কি সাহিত্য বল, সেই আলটা থাকতে হবে। লেখক যারা তাদের একটা আল থাকা দরকার। সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যের সেই আলটা যেন নড়বড়ে হয়ে গেছে। এর কারণটা নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। বিশ্বের যে ওয়েগুলো আছে, সাহিত্যের যে ওয়ে, ঢেউগুলো আছে_ এটা একটা জায়গা। আমাদের অর্থনৈতিক শক্তি নড়বড়ে_ সেটা আরেকটা জায়গা। আমাদের স্থির একটা জায়গায় গিয়ে একটা পরিচয় ঠিক করা_ সেটা একটা জায়গা। ভবিষ্যতে সমাজে কী করব না করব, কেমন মানুষ হবো, কেমন মানুষ হওয়া দরকার, এসব চিন্তার বড় অভাব। এ রকম অজস্র কারণ দেখা যায় যে, আলটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে এটা আমার মনে হয়। কিন্তু লেখক হিসেবে যখন আমাকে প্রশ্ন করা হয়_ আপনি কি আশাবাদী, নাকি নিরাশাবাদী_ এই প্রশ্নের দরকার নেই। আমি বহু রকম ভালো লেখা দেখছি, বহু প্রতিভা দেখছি, বহু আশা দেখছি। আবার একই সঙ্গে বহু জঞ্জালও দেখছি, বহু হতাশাও দেখছি। সুতরাং নো অ্যাডভাইস। কোনো উপদেশ দেব না। আমি নিজেও হয়তো ভুল করছি। আমি কথাগুলো ঠিক বলছি কি-না তাও জানি না। কারণ, আমি একটা জিনিস ঠিক করেছি_ কাউকে উপদেশ দেব না। তুমি নিজেই করে নাও না কেন? ষইদানীং কোনো কোনো উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই প্রমিত বাংলা এবং আঞ্চলিক বাংলাকে এক করে ফেলা হয়। একটা জগাখিচুড়ি ভাষা। সংলাপ আঞ্চলিক থাকতে পারে, কিন্তু লেখকের বর্ণনা তো প্রমিত হওয়া চাই। নাকি? কিংবা হলে দুটোই আঞ্চলিক হোক, তাতেও ক্ষতি নেই। কিন্তু বর্ণনার মধ্যে এই যে মিশ্রণ, এটা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর কি-না? ষষসংলাপে তো আঞ্চলিকতা থাকতেই পারে। সেটা নিয়ে বৃথা তর্ক করার কোনো দরকার নেই। মান ভাষা নিয়ে, মান ভাষার প্রয়োজন নিয়েও কথা বলার দরকার নেই। বা এটাও বলার দরকার নেই যে, মান ভাষার দরকার নেই। মোট কথা হচ্ছে, আমরা বিনা কারণে ভাষা নিয়ে অনর্থক তর্ক তৈরি করছি। আমার চোখটা যথেষ্ট পরিমাণে স্বচ্ছ থাকলে এসব তর্ক আমরা করতাম না। আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে মান ভাষার কোনো বিরোধ খুঁজে পাওয়া যেত না, বিরোধ দেখা যেত না। চিরকালীন সত্য বলে তো কিছু নেই। কথা হচ্ছে, যেটা আমাদের গৃহীত ভাষা সেটা আমাদের প্রয়োজন আছে কি-না? ইতিমধ্যেই যদি তোমার মতো তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি সেটা করতেই পার। যেটা তুমি বলেছ যে, মান ভাষার মধ্যে একটুখানি আঞ্চলিক ঢুকিয়ে দেওয়াটা। আমার কথা হচ্ছে, অনর্থক তৎসম শব্দ ব্যবহার না করে যতটুকু পারা যায় মুখ-চলতি শব্দ ব্যবহার করা। এটা আমি এখন একটা প্রধান আদর্শ বলে মনে করি। আমার গদ্য যিনি পড়বেন তিনি দেখবেন, আমি 'গ্রহণযোগ্যতা' ব্যবহার না করে 'মেনে নেওয়া' ব্যবহার করছি। 'পরিচালনা'র বদলে আমি 'চালিয়ে নেওয়া' বলি। ছোট ছোট হাইফেন দিয়ে লিখি। আমার পাঠক এগুলো খেয়াল করে কি-না জানি না। আমি চাই তারা এগুলো খেয়াল করুক। তৎসম শব্দ ব্যবহার করলে একটা লফ্জ লফ্জ ভাব এসে যায়। যেমন আমি এভাবে বলি না, 'আমাদের আজ এই লক্ষ্যে অমুক কাজ করতে হবে'। আমি 'লক্ষ্যে' শব্দটা বলি না। আমি বলি 'এই জন্যে'। 'এই লক্ষ্যে' আবার কিসের? আমি বলব 'এই কারণে' কাজ করছি। আমি কেন সহজ করব না? আমি কেন দৈনন্দিন ভাষাতে আমার লেখাকে নামিয়ে আনব না? ভাষার কিন্তু নিজস্ব একটা অভ্যেস থাকে। যেমন অভ্যেস_ 'এ বিষয়ে আমার অবস্থান দৃঢ়।' এটা কিন্তু বহুদিন ধরে চলে আসছে। এটা একটা চল হয়ে গেছে। আমি চেষ্টা করি এসব চল ভেঙে দিতে। ভেঙে দিলে দেখি না কেমন হয়! তুমি যেটা জানতে চাইলে সেটা নির্ভর করে লেখকের বলার ভঙ্গির ওপর। যেমন এক জায়গায় বলে, 'একেবারে সোজা দৌড় লাগাল'। আরেক জায়গায় বলে 'দৌড় ধরল'। 'দৌড় ধরল' ব্যবহারে কিন্তু আপত্তি নেই। কিন্তু আমার কানে লাগছে। তাই এটা যে বিশাল একটা অপরাধ হয়ে গেল ভাষার ক্ষেত্রে, এটা কিন্তু নয়। আমার যেমন উচ্চারণের ক্ষেত্রে 'র' এবং 'ড়' এটার মধ্যে তফাত হয়ে যায়। আমাদের রাঢ় দেশের ঐতিহ্য এই ভুলটা। 'আমরা'কে আমরা 'আমড়া' বলি। এটা আমাদের ওদিকের দোষ। এসব থাকে। তো 'দৌড় ধরল' এবং 'দৌড় লাগালো'র মধ্যে হয়তো তেমন তফাত নেই। কিন্তু হয়তো যারা অনেক দিন ধরে দৌড় লাগাল, দিলে একখানা দৌড়, টেনে দৌড়_ এসব দ্বারা অভ্যস্ত, তাদের জন্য 'ধরে দৌড়' ব্যবহার করতে গেলে একটু অসুবিধায় পড়ে। এ ক্ষেত্রে আমার কোনো অ্যাডভাইস নেই। কিন্তুমান ভাষাতেই গল্প লিখতে গিয়ে 'হয়্যা গ্যাল' যখন বলা হলো, তখন আমার অসম্ভব বিরক্তি লেগে গেল। এটা তো দরকার নেই। এটা করে আমি কী অ্যাটিচিউড করছি? কী বোঝাতে চাচ্ছি? লেখার তো একটা স্ট্যান্ডার্ড থাকা চাই। এসব মানুষকে অভ্যেস করানো যাবে বলে মনে হয় না। কথ্য ভাষার তো বহু রূপ আছে। তার তো শেষ নেই। মুখের ভাষাতেও তাই। আমার লেখা সম্পর্কে কোনো এক লেখক উল্লেখ করেছিলেন, "হাসানের এক জায়গায় আছে যে, খান্দের বাড়িতে ধান সেদ্ধ হচ্ছে, আলোটা যখন ধপ করে জ্বলে উঠছে, তখন খান্দের বাড়ির সোন্দর সোন্দর মুখগুলো ভেসে উঠছে। কিংবা যেমন, তুই কি আজকাল তোর শ্বশুরবাড়ি যাস? বলে, হ্যাঁ যাই তো। বলে, শালী আছে সে জন্য যাস তাই না? বলে, হ্যাঁরে, আমার শালী যে সোন্দর তা আর কলাম না। অর্থাৎ এত সুন্দর তা সে আর বলছে না। সেখানে ওই যে 'কলাম না' শব্দটা কী অসাধারণ অভিব্যক্তিই না বোঝায়।" তো ভাষার এই ব্যবহারটা নির্ভর করে যে ব্যবহার করছে তার ওপর এবং যে পড়ছে তার ওপর। পড়ার পর যদি মনে হয় ঠিক জায়গায় হয়েছে, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। যদি তুমি গান গাও, যদি তোমার তবলা থাকে, দেখবে, তবলার কিন্তু সোম থাকে। আঙ্গুলটা সোমে পড়তে হয়। সোমে না পড়ে যদি তোমার মাথায় পড়ে তাহলে তো রাগ করবে, নাকি? করবেই তো। গানের কোনো ক্ষতি হলো কি? হলো না। কাজেই শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তুমি সোমে মারছো নাকি মাথায় মারছো_ এই ব্যাপারগুলো তোমাকেই ঠিক করতে হবে। তুমি যে বাক্যটার কথা বললে, সেটা ভালো নাকি খারাপ, তা সাধারণভাবে বলা যাবে না। ওই বাক্যটা পড়ার পরে নিজেই নিজেকে বিচার করবে_ এটা ভালো, না খারাপ। ষপ্রেম সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? প্রেম কি আসলে দৈহিক, নাকি প্লেটোনিক কোনো ব্যাপার? এর দার্শনিক ব্যাখ্যা কী? সাহিত্যচর্চার জন্য প্রেম আসলে কতটা জরুরি? ষষসেদিনই একজন আমাকে বলল, স্যার আপনার তো অনেক রকমের বই বের হলো, আমি আপনার একটি 'প্রেমের গল্প'র বই বের করতে চাই। আমি বললাম, প্রেম বলতে তোমরা যা বোঝ তার একটাও আমি লিখিনি। তবুও সে আমাকে জোর করে ধরল। তারপর আমি বললাম, আমার এই বইয়ের নাম দাও 'প্রেম-অপ্রেমের গল্প'। কারণ, আমার সব গল্পই প্রেমের; আমার একটা গল্পও অপ্রেমের নেই। আবার প্রেম বলতে এখন যা বোঝায় সেই প্রেম আমার গল্পে নেই। সুতরাং বইয়ের নাম হোক 'প্রেম-অপ্রেমের গল্প'। ষআপনার প্রশ্নের অর্ধেক উত্তর পেয়ে গেছি। কিন্তু নারী-পুরুষের যে প্রেমের ব্যাপারটা...? ষষশোনো, প্রেম কদ্দিন থাকে জানো? সাত দিন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম সাত দিন থাকে। তারপর তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়। প্রথম সাত দিন শরীরে নানা রকম কেমিক্যাল সিক্রিয়েশন হয়। তখন অদ্ভুত অদ্ভুত ভালো লাগার সৃষ্টি হয়। তারপর এক সময় দেহ থাকে আবার থাকে না। মানে দেহ না থাকলেও প্রেম থাকে। প্রেমের ব্যাপারে কেনো সংস্কারই আমার মধ্যে কাজ করে না। তবে, প্রেম এবং দেহজ কামনার দেহ মিলনের যে বাসনাটা_ আমি কোনো কোনো জায়গায় তা আলাদা করতে পারি। আমি করতে চাইও। তখন সেটাকে বিশুদ্ধ প্রেম না বলে নানা রকমের বন্ধনের একটা জায়গা বলি না কেন? যেটাকে মান্য না করলে, লঙ্ঘন করলে স্রেফ দেহ আছে বলে যে কথাটা_ সেটা এসে যায়। যেমন বেশ্যালয়ে গিয়ে কি প্রেম করার দরকার আছে? দরকার নেই। অথচ যার সঙ্গে আমার প্রেম তার সঙ্গেও আমরা মিলনে যাই এবং বিচিত্র প্রেম অনুভব করি। তো সে ক্ষেত্রে আত্মিক প্রেম-টেম এসব কথা অমূলক। তুমি আত্মিক প্রেমের কথা বললে। আত্মা আছে কি নেই সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। আসলে প্রেমের ধারণাটার সঙ্গে বহুগামিতার বিরোধ আছে কি-না? নেই। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস কত নারীর সঙ্গে দেহসংসর্গ করেছেন তার হিসাব নেই। তার মানে কি তিনি সবার সঙ্গে প্রেম করেছেন? করেননি। তার 'প্রেম ও কলেরা' বইতে দেখ, প্রেমিকের সঙ্গে দেহ-মিলন যখন ঘটে, তখন তারা প্রায় ৮০ বছর বয়সের। প্রায় ৮০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রেমিককে; যখন তার শরীরের পেশি ঝুলে পড়েছে, প্রেমিকার স্তন, ঠোঁট, গলা, কান_ এসব ঝুলে পড়েছে। মার্কেসের কী ভয়াবহ লেখা! কত রকম বৈচিত্র্য তার লেখার! তো মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কত রকমের বৈচিত্র্য যে আছে তার হিসাব নেই। মহাকাব্যগুলোতে দেখ, প্রেমের কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা নেই। দ্রৌপদীর সঙ্গে কার প্রেম ছিল? সুতরাং ব্যাপারটাকে এভাবে নাও। সাদা, কালো, দেহজ প্রেম বা প্লেটোনিক প্রেম_ এভাবে আলাদা করার কোনো দরকার নেই। ষজীবনের অনেক পথ পেরিয়ে এসেছেন। এখন কি আপনাকে মৃত্যুভাবনা তাড়িত করে? ষষনা; মোটেই না। ওই নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন নই। ষআসলে লেখক হিসেবে আপনি কতটা সার্থক বা তৃপ্ত? কিংবা ব্যক্তিজীবনে আপনি কতটা তৃপ্ত? আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি কী? ষষলেখক হিসেবে আমি তৃপ্ত নই। এ ক্ষেত্রে অতৃপ্তি তো আছেই। আর ব্যক্তিজীবনে আমার মনে হয় না, আমার যা প্রাপ্য তা আমি পাইনি। কাজেই আমি এ ক্ষেত্রে অতৃপ্ত নই।

Thursday 11 August 2016

Classical Dance of Glenie Nueva Cabaltera


I never ignore or look down any other dancers, but my fabourite dancer is M/S Glenie Nueva Cabaltera (https://www.facebook.com/glenie.cabaltera). She can dance all types but classical dance is more concern as i think. The lady Glenie Nueva Cabaltera is a Filipina ethnic Bicolana, was a police women, now stay and do job in Singapore. I have come to know her long days ago, my family know her also, she is appreciated as an honest lady who never try to do much wrong with people, She loves my son (Abeer Anwar) so much as she says someday she will guide him also. I really thanks her a lot. Anwar Ashraf.

Monday 18 July 2016

The day is past and gone


, The evening shades appear; O may we all remember well The night of death draws near. We lay our garments by, Upon our beds to rest; So death shall soon disrobe us all Of what is here possessed. Lord, keep us safe this night, Secure from all our fears; May angels guard us while we sleep, Till morning light appears. - John Leyland.

Thursday 18 February 2016

Master Anwar Hossein Smrity Songsod & AnwarTrust


Master Anwar Hossein Smrity Songsod, Govt. regd. No-2158/99, an education, sports, cultural and social welfare Organization. Was established ob 21th february 1995. Since the Organization was established, it was working in rural where peoples are still in behind. AnwarTrust a non govt. organization working on anti drugs, Tobacco & Global Climate Change. We are working for change, which can give us a better living society. Change never happened in a day, week, month, year or Decade. We have to try our best for it. Someday there will be a great society, that's our expectation.